চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফলে প্রশাসনে অসন্তোষ বাড়ছে

প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ১২:১৬ | অনলাইন সংস্করণ

  আমার বার্তা অনলাইন

প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতে ধারাবাহিকভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার কারণে নিয়মিত ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সুযোগ কমে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। এতে প্রশাসনের ভেতরে অসন্তোষ বাড়ছে এবং কর্মপরিবেশেও প্রভাব পড়ছে বলে জানিয়েছেন সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তা।

বর্তমানে বেসামরিক প্রশাসনে প্রায় ৮০ জন সচিব ও সচিব–মর্যাদার কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে কমপক্ষে ২০ জন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত। তাদের অন্তত ১০ জন সিনিয়র সচিব পদে রয়েছেন।

গত ১৪ মাসে অন্তর্বর্তী সরকার ১২ জন সচিব ও সিনিয়র সচিবকে চুক্তিভিত্তিকভাবে শীর্ষ পদে নিয়োগ দিয়েছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, একসঙ্গে এত সংখ্যক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এর আগে দেখা যায়নি।

কোন কোন পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ?

বর্তমানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসন সচিব এবং স্বরাষ্ট্র সচিব – চারজনই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত। তাদের মধ্যে কয়েকজন বহু বছর আগেই অবসর নিয়েছিলেন।

উদাহরণ হিসেবে, মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদের নিয়মিত চাকরি থেকে প্রায় ১৫ বছরের বিরতি ছিল। ২০০৯ সালে তিনি ওএসডি হন এবং ২০১৬ সালে অবসরে যান। অন্যদিকে, মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, জনপ্রশাসন সচিব মো. এহছানুল হক, স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনি, মহিলা ও শিশুবিষয়ক সচিব মমতাজ আহমেদ এবং পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এম এ আকমল হোসেন আজাদ ও মো. মোখলেস–উর–রহমানও দীর্ঘ বিরতির পর চুক্তিতে দায়িত্বে ফিরে আসেন। তারা ২০০৯ সালে ওএসডি হয়েছিলেন।

 কেন অসন্তোষ?

নিয়মিত প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দায়, প্রতিটি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে অন্তত তিন থেকে চারজন কর্মকর্তার পদোন্নতির সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কর্মকর্তা পর্যায়ে হতাশা বাড়ছে।

এক অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “১০ থেকে ১৫ বছর প্রশাসনের বাইরে থাকা অনেকেই এখনকার প্রযুক্তিনির্ভর প্রশাসন পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছেন। তারা যদি কাজেই না পারেন, তাহলে কেন বদলি করে আবার প্রশাসনে রাখা হচ্ছে?”

 চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল?

উপদেষ্টা পরিষদের এক সদস্য বলেন, জুলাই আন্দোলনের পর প্রশাসনে বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়েছিল। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদে যারা ছিলেন, নতুন সরকার তাদের দায়িত্বে রাখতে চায়নি।তার ভাষায়,“অবহেলিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে সচিব করার মতো পর্যাপ্ত সময় তখন ছিল না। তাই প্রথম দিকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ছাড়া সরকারের বিকল্প ছিল না। তবে এখন ধীরে ধীরে এই সংখ্যা কমানো উচিত।”

বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?

সাবেক সচিব এবং জনপ্রশাসন–বিশেষজ্ঞ এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার মনে করেন,“চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হলে যোগ্য কর্মকর্তাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়। বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এড়িয়ে চলা উচিত।”

সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান বদিউর রহমানের মতে,“সরকার চুক্তিতে নিয়োগ দিলেও অবসরপ্রাপ্তদের উচিত এসব প্রস্তাব না নেওয়া। এতে সিভিল সার্ভিসের স্বাভাবিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়। যারা চুক্তির জন্য তদবির করেন, তারা ভালো কর্মকর্তাদের দলে পড়েন না।”

জনপ্রশাসন–বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন,“আগের কোনো সরকার সিভিল সার্ভিসের শীর্ষ চার–পাঁচটি পদ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে পূরণ করেনি। এতে পদোন্নতির অপেক্ষায় থাকা কর্মকর্তারা নিরুৎসাহিত হন। এর ফলে প্রশাসনের কাজকর্মও ব্যাহত হতে পারে।”

বদলি—আরও বিতর্ক?

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত কমপক্ষে চারজন সচিবকে গত এক বছরের ভেতর বদলি করা হয়েছে। সচরাচর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্তদের বদলি করা হয় না। এই নজিরবিহীন বদলি কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রশ্ন তুলেছে।

উদাহরণ হিসেবে:

নৌপরিবহন সচিব মোহাম্মদ ইউসুফকে সম্প্রতি সরিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। তার নির্দিষ্ট কোনো দায়িত্ব নেই, কিন্তু সিনিয়র সচিবের সব সুবিধা থাকছে।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের চুক্তিভিত্তিক সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদকে মাত্র তিন মাসের মাথায় বদলি করা হয়। পরবর্তী দুই ধাপ বদলির পর তিনি এখন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে নয় মাস পর সরিয়ে সংযুক্ত করা হয়। পরে তার স্থলে অতিরিক্ত সচিবের পদের জন্য একজন সিনিয়র সচিবকে বসানো হয়।

জনপ্রশাসন সচিবের দায়িত্ব ১৩ মাস পালন করা মোখলেস–উর–রহমানকে গত মাসে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়।

সামনে কী?

প্রশাসনের অনেকের মত, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ধাপে ধাপে কমানো এবং নিয়মিত ক্যাডারের যোগ্য কর্মকর্তাদের দ্রুত পদোন্নতি দেওয়ার মাধ্যমে এই পরিস্থিতির সমাধান সম্ভব। - সূত্র : ডেইলি স্টার


আমার বার্তা/জেএইচ